বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তিন বৈঠক

Social Share Buttons

সেপ্টেম্বরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করার বিষয়ে আলোচনা করছে সরকার। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী সপ্তাহে স্টেট ডিপার্টমেন্টের গ্লোবাল অ্যান্টি করাপশন বিভাগের সমন্বয়ক রিচার্ড নেফিউ ঢাকা আসবেন। দুই দেশের মধ্যে নিয়মিত বৈঠকের অংশ হিসেবে মিলিটারি টু মিলিটারি সংলাপ ও বাণিজ্য বিষয়ক টিকফা বৈঠকের সম্ভাবনা আছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নিরাপত্তা সংলাপেরও সম্ভাবনা আছে বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, চলতি বছর বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক হয়ে গেছে। এ ছাড়া আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়া, অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু ঢাকা ঘুরে গেছেন। দুপক্ষের মধ্যে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে।

দুই দেশের মধ্যে অধিকারভিত্তিক বিষয়গুলো যেমন: নির্বাচন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, শ্রম অধিকার, আইনের শাসনসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে মতপার্থক্যের বিষয়ে তিনি বলেন যে কূটনীতিতে এটি হতে পারে। কিছু বিষয়ে দুপক্ষের মধ্যে মতের মিল রয়েছে। আবার একইভাবে মতের অমিলও রয়েছে। এটি স্বাভাবিক একটি বিষয়।

দুপক্ষের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্র
বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সহযোগিতা বহুমুখী ও বিভিন্ন ধরনের। তবে গোটা সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলোকে মোটামুটি পাঁচটি ভাগে ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হচ্ছে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, উন্নয়ন সহযোগিতা, নন-ট্র্যাডিশনাল নিরাপত্তা সহযোগিতা যেমন জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবপাচার সংক্রান্ত সহযোগিতা, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এবং অধিকারভিত্তিক আলোচনা।

প্রথমত, দুপক্ষের বাণিজ্যিক ও বিনিয়োগ সম্পর্ক। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রফতানি বাজার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। আবার যুক্তরাষ্ট্র থেকেও বাংলাদেশ বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করে থাকে। সম্প্রতি তুলা আমদানির বিষয়ে জটিলতা নিরসনের পর আশা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি আরও বাড়বে। এ ছাড়া বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় বিনিয়োকারী হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি খাতে তারা বিনিয়োগ করেছে এবং আরও করতে আগ্রহী।

দ্বিতীয়ত, মার্কিন সংস্থা ইউএসএআইডি স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন সহযোগিতা করে আসছে বাংলাদেশকে। স্বাধীনতার পর মার্কিন দূতাবাসে যতজন কাজ করতেন, তার চেয়ে বেশি কাজ করতেন ইউএসএআইডি বাংলাদেশ অফিসে। প্রতিবছর বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে প্রায় ২০ কোটি ডলার সহায়তা দিয়ে থাকে সংস্থাটি।

তৃতীয়ত, নন-ট্র্যাডিশনাল নিরাপত্তা সহযোগিতার অধীনে দুই দেশ অনেক কাজ করে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। বাংলাদেশ থেকে মানবপাচার রোধ করার জন্যও যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা দিচ্ছে। করোনা মহামারির সময় বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি টিকা অনুদান হিসেবে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।

চতুর্থ, প্রতিরক্ষা সহযোগিতার অধীনে দুই দেশের সামরিক বাহিনী একে অন্যের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের যোগাযোগ করে থাকে। গত জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে একটি সামরিক প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করেছে। আবার বাংলাদেশ থেকে অনেক সেনা অফিসার যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণের জন্য গিয়েছেন। দুই দেশের মধ্যে জিসোমিয়া ও আকসা চুক্তি করা নিয়েও আলোচনা চলছে।

পঞ্চম, হলো অধিকারভিত্তিক আলোচনা। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, শ্রম অধিকার, আইনের শাসনসহ বিভিন্ন বিষয়ে দুপক্ষের মধ্যে আলোচনা চলমান রয়েছে। সিভিল লিবার্টি যেমন ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন, সমাবেশ করার স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের, গণমাধ্যমের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তারা উদ্বেগ জানিয়েছে সরকারকে। তাদের বিবেচনায় অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হচ্ছে সিভিল লিবার্টি। এ ছাড়া আইনের শাসন ও শ্রম অধিকার পরিস্থিতি নিয়ে তাদের নিজস্ব মতামত রয়েছে এবং বিভিন্ন স্তরে এ বিষয় নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়।

পাঁচটি ক্ষেত্রের মধ্যে অধিকারভিত্তিক বিষয়গুলো ছাড়া মোটামুটিভাবে সব ক্ষেত্রে দুপক্ষের সহযোগিতা ইতিবাচকভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পাশাপাশি আঞ্চলিক বাস্তবতা ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় নিয়ে এক দেশের সঙ্গে সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।

এ বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার মো. শহীদুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ আগেও ছিল এবং এখনও আছে। শুধু পরিবর্তন হয়েছে সময় ও প্রেক্ষাপট। বাংলাদেশের সক্ষমতা এখন আগের যেকোনও সময়ের থেকে বেশি এবং সম্ভাবনা ও সুযোগ অনেক গুণ বেড়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য দেশগুলোর নজর এড়িয়ে যাচ্ছে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরের ঠিক কেন্দ্রে বাংলাদেশের অবস্থান এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশের ভৌগোলিক গুরুত্ব এখন আগের থেকে বেশি। অন্যদিকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ অনেক বেশি।’

সম্প্রতি বাংলাদেশ তার ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক ঘোষণা করেছে, যার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মৌলিক নীতিগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য আছে। ফলে সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে দুপক্ষের আগ্রহ আছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি হচ্ছে মূল্যবোধ ও মানবাধিকার এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নেওয়ার ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলোকে তারা বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে থাকে বলে জানান সাবেক পররাষ্ট্র সচিব।

মো. শহীদুল হক বলেন, ‘দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য থাকবে, এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু দুই দেশ যোগাযোগ ও আলোচনা অব্যাহত রেখেছে এবং এটিই দুপক্ষের কাছ থেকে সবাই আশা করে। দুই দেশের সরকার পরিপক্ব এবং নিজেদের জাতীয় স্বার্থের বিষয়ে ওয়াকিবহাল। গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমেই মতপার্থক্য দূর করতে হবে।’

একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘যেকোনও সম্পর্ক গতিশীল। এখন যে বিষয়গুলোকে নিয়ে মতের অমিল আছে, সেটিতে একসময় মিল হয়ে যাবে। কিন্তু তখন হয়তো নতুন কোনও মতপার্থক্যের বিষয় সামনে চলে আসবে। এটি একটি অব্যাহত প্রক্রিয়া। সে জন্য কূটনীতিতে সম্পর্ক অত্যন্ত খারাপ বা নেতিবাচক মনোভাবের সুযোগ নেই। ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমেই সবার সঙ্গে মতপার্থক্য দূর করতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *