মেসির বহু আগে যুক্তরাষ্ট্রে ফুটবল উন্মাদনা নিয়ে এসেছিলেন পেলে

Social Share Buttons

১ অক্টোবর ১৯৭৭। মুখোমুখি সান্তোস আর নিউ ইয়র্ক কসমস। প্রথমার্ধে কসমসের জার্সিতে খেললেন তিনি। দ্বিতীয়ার্ধে নামেন সান্তোসের জার্সি জড়িয়ে। ম্যাচ শেষে আর কোনো জার্সি ছিল না শরীরে। তিনি তখন তার নতুন-পুরোনো সতীর্থদের কাঁধে। আর চারপাশ থেকে আসছিল ভক্তদের চিৎকার, পে-লে! পে-লে! পে-লে!

ইউরোপের পাট চুকিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছেন লিওনেল মেসি। পিএসজি ছেড়ে মেসির ইন্টার মিয়ামিতে যোগদান নিশ্চিত হওয়ার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে উঠেছে ফুটবলের জোয়ার। মার্কিন ফুটবলভক্তরা এই আর্জেন্টাইনের পায়ের জাদু দেখার দিনক্ষণ গুনছেন। টিকেটের দাম বেড়েছে কয়েকশগুণ

তবে মেসিই প্রথম ব্যক্তি নন, যিনি মার্কিন মুলুকে ফুটবল উন্মাদনা সৃষ্টি করেছেন। ৪৮ বছর আগে ফুটবলের বরপুত্র পেলের আগমনেও যুক্তরাষ্ট্রে দেখা গেছে এমনই কাণ্ড। তবে সে সময় একই সাথে ছিল সংশয় ও রোমাঞ্চের মিশেল।

ক্যারিয়ারের গোধূলি লগ্নে, ১৯৭৫ সালে পেলে যোগ দেন নর্থ আমেরিকান সকার লিগের (এনএএসএল) ক্লাব নিউ ইয়র্ক কসমসে। আমেরিকান ‘সকারে’ তার আগমনের খবর প্রথম ছাপিয়ে বদলে গিয়েছিল সাংবাদিক ডেভিড হিরশে-র পেশাজীবনও। তখন নিউ ইয়র্ক ডেইলি নিউজে কাজ করতেন হিরশে।

এই সাংবাদিক বলেন, মার্কিন ক্রীড়াজগতে পেলের আগমন ছিল ভূমিকম্পের উত্থানের মতো। আড়াই বছরে পেলে মার্কিন ফুটবলের চিত্রপট বদলে দেন। অভিবাসীদের খেলা থেকে ফুটবলকে প্রাণবন্ত জাতীয় খেলায় রূপান্তর করেন পেলে। এক ম্যাচে নিউ জার্সির বিশাল স্টেডিয়ামে ৭৭ হাজারের বেশি দর্শক আগমনের ঘটনাও দেখা গেছে।

ব্রাজিলের হয়ে তিনটি বিশ্বকাপ জয় ও দেশটির বিখ্যাত ক্লাব সান্তোসে ১৮ বছর কাটিয়ে নিউ ইয়র্ক কসমসে যোগ দেন পেলে। যুক্তরাষ্ট্রে ফুটবলের প্রচারণার জন্য পেলেকে রাজি করাতে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার সাও পাওলো চলে যান। পেলে তখন আন্তর্জাতিক ফুটবলকে বিদায় জানিয়েছেন। সান্তোসেই নিজের ক্যারিয়ার শেষ করতে চেয়েছিলেন। তবে শেষে মত বদলে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। স্পেন ও ইতালির লোভনীয় অফার বাদ দিয়ে তিনি মার্কিন সকারকে বেছে নেন।

ম্যানহাটনে পেলের চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের ঢল নামে। সে সময় সবচেয়ে বেশি বেতন পাওয়া ফুটবলার বনে যান পেলে। তিন বছরের চুক্তিতে পেলের বেতন নির্ধারিত হয় ৪.৭৫ মিলিয়ন ডলার। যা সে সময় আকাশছোঁয়া। হিরশে সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি জানান, ছবি তোলার জন্য পছন্দসই জায়গা পেতে দুই ফটোগ্রাফারের মধ্যে সেদিন হাতাহাতি হয়। পেলের মঞ্চে ওঠা পর্যন্ত চলে সেই ধস্তাধস্তি।

তখনকার মুহূর্ত স্মরণ করে হিরশে বলেন, ‘মনে হচ্ছিল যেন দাঙ্গা লেগেছে। মানুষের এত বেশি উৎসাহ দেখে সেদিন প্রথমবার আমার মনে হয়েছিল আমেরিকায় ফুটবল জনপ্রিয় হয়ে ওঠার সুযোগ আছে। সেই নিউজ কনফারেন্স থেকে জুনের ১৫ তারিখে ডালাস টর্নেডোর বিপক্ষে পেলের অভিষেক পর্যন্ত এই ব্রাজিলিয়ানের প্রভাব সমান বিদ্যমান ছিল।

১৯৭২ সালে যখন নিউ ইয়র্ক কসমস লিগ শিরোপা জেতে, সে বছর বার্গার কিং ডাবল হুপার কিনলেই ফ্রি টিকেট দিত ক্লাবটি। হিরশে জানান, তিন বছর পর, পেলের অভিষেকের সময় তিনি দেখতে পান র‌্যানডল আইল্যান্ডে কসমসের স্টেডিয়ামের বাইরে কালোবাজারে টিকেট বিক্রি হচ্ছে ৬ থেকে ১০০ ডলারে।

পেলের অভিষেক ম্যাচে খেলা শুরুর ৩০ মিনিট পরও টিকেটের জন্য মানুষ লাইন ধরে ছিল বলে জানান হিরশে। সেদিন অন্তত এক হাজার দর্শক মাঠে ঢুকতে পারেনি। ১৯৭২ সালে বার্গারের সাথে ফ্রি টিকেটে দর্শক উপস্থিতি ছিল ৬ হাজার। আর পেলের অভিষেকের দিন মাঠে দর্শক ছিল ২১ হাজার ২৭৮ জন। আর সিবিএস টিভিতে প্রায় এক কোটি মানুষ সেদিনের ম্যাচ উপভোগ করে, যা সে সময় কোনো মার্কিন ফুটবল দর্শকের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ।

২-২ গোলে ড্র হওয়া সেই ম্যাচে পেলে নিজে একবার বল জালে জড়ান, আরেক গোলে সহায়তা করেন। ম্যাচটিতে তার সতীর্থরা অনেকটা দর্শকের ভূমিকা নিয়ে খেলছিলেন। ম্যাচের পর পেলের বলেন, ‘কসমসের কিছু খেলোয়াড়, বিশেষ করে লেফট উইঙ্গারের সুযোগ ছিল বল আরও সামনে নিয়ে গিয়ে অন্য ফুটবলারকে পাস দেওয়ার। কিন্তু সে আমাকে দিয়েছে। এটা স্বাভাবিক।’

প্রথম মৌসুমের পর নিজেদের মাঠে কসমসের দর্শক সংখ্যা তিনগুণ বেড়ে যায়। আর অ্যাওয়ে ম্যাচের ক্ষেত্রে কসমস ছিল একমাত্র ক্লাব, যেটি হোম টিমের স্ট্যান্ডের টিকেট পেত।

কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটে। পেলের অভিষেকের ছয় দিন পর বোস্টনের বিপক্ষে ম্যাচে স্টেডিয়ামের ১২ হাজার ৫০০ দর্শক ধারণক্ষমতা থাকলেও ঢুকে পড়ে ২০ হাজার। বাকি দর্শকরা মাঠের পাশে, গোলবারের পেছনে গিয়ে বসে। শুরুতে পর্তুগিজ তারকা ইউসেবিওর গোলে এগিয়ে যায় বোস্টন। পরে দ্বিতীয়ার্ধে পেলে বল জালে জড়ান। কিন্তু সে গোল বাতিল করায় দর্শকরা ক্ষিপ্ত হয়ে মাঠে ঢুকে পড়েন।

দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, দর্শক, দেহরক্ষী, নিরাপত্তা কর্মকর্তা আর ক্লাব কর্তৃপক্ষের ভিড়ে পেলেকে অনেকসময় দেখতে পাওয়া যায়নি। কেউ একজন তার জুতা ও প্যান্ট খুলে নেয়। সতীর্থরা উদ্ধার করতে করতে পেলে হাঁটু আর কনুইতে চোট পেয়ে যান।

পেলে তিন বছর কসমসের হয়ে খেলেন। এসময়ের মধ্যে তিনি ৩৭ গোল ও ৩০ অ্যাসিস্ট করেন। ১৯৭৬ সালে লিগের সেরা খেলোয়াড় মনোনীত হন তিনি। আর ১৯৭৭ সালে কসমসের হয়ে লিগ জেতেন। তাকে ক্লাবে নিতে গিয়ে ব্রাজিলিয়ান অধিনায়ক কার্লোস আলবার্তো, জার্মান কিংবদন্তি ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার ও ইতালির জর্জিও চিনাগলিয়ার মতো তারকাকে দলে ভেড়াতে পারে নিউ ইয়র্ক কসমস।

২০১৫ সালে বেকেনবাওয়ার দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘আমার সবকিছু ছিল। আমি বায়ার্ন মিউনিখ ও জার্মান জাতীয় দলের অধিনায়ক ছিলাম। এ সময় কসমসের প্রস্তাব আসে…১৯৫৮ সালে বিশ্বকাপের সময় আমার বয়স ১৩। সুইডেনে পেলের খেলা দেখার পর থেকে তিনি আমার আদর্শ বনে যান। ১৯৫৮ থেকে এখন পর্যন্ত আমি পেলেকে অত্যন্ত পছন্দ করি। আমি নিজেকে বললাম (প্রস্তাব আসার পর), এটা সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়ের সাথে খেলতে পারার সেরা সুযোগ।’

পেলে তার জীবনের শেষ আনুষ্ঠানিক ম্যাচ খেলেন ১৯৭৭ সালের ১ অক্টোবর। সান্তোস আর নিউ ইয়র্ক কসমস সেদিন মুখোমুখি হয়। প্রথমার্ধে তিনি কসমসের জার্সিতে খেলেন আর দ্বিতীয়ার্ধে নামেন সান্তোসের জার্সি জড়িয়ে। ম্যাচ শেষে আর কোনো জার্সি ছিল না শরীরে। পেলে তখন তার নতুন ও পুরোনো সতীর্থদের কাঁধে। আর চারপাশ থেকে আসছিল ভক্তদের চিৎকার, পে-লে! পে-লে! পে-লে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *