উচ্চ আদালতে আটকে আছে সিনহা হত্যার বিচার

Social Share Buttons

৩১ জুলাই ২০২০। কক্সবাজারের টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ এলাকায় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানকে হত্যা করা হয়। বহুল আলোচিত এ হত্যা মামলার বিচারিক আদালতের রায়ের দেড় বছর পেরিয়ে গেছে। এখনও এ মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও সাজাপ্রাপ্ত সব আসামির আপিল শুনানির জন্য পেপারবুক প্রস্তুত শুরু হয়নি।

এ কারণে আলোচিত এ মামলার আপিল শুনানি কবে নাগাদ শুরু হবে সংশ্লিষ্ট কেউ তা বলতে পারছেন না। তবে মামলার বাদী ও মেজর সিনহার বোন বিচারিক আদালতের মতো উচ্চ আদালতেও মামলাটি দ্রুত সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তির আশা প্রকাশ করেছেন।

জানতে চাইলে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার মুহাম্মদ সাইফুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সিনহা হত্যা মামলার পেপারবুক যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। ক্রম অনুযায়ী এসব পেপারবুক তৈরি হয়। পেপারবুক প্রস্তুত হলে নিয়ম অনুযায়ীই মামলাটি শুনানির জন্য প্রস্তুত করা হবে।

কোনো মামলায় বিচারিক আদালত আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিলে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৪ ধারা অনুসারে সে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করতে হাইকোর্টের অনুমোদন লাগে। যে কারণে দেশের বিচারিক আদালত আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিলে সে মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের আবেদন হাইকোর্টে পাঠানো হয়; যা ডেথ রেফারেন্স নামে পরিচিত।

ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসার পর ডেসপাস (আদান-প্রদান) শাখা তা গ্রহণ করে পেপারবুক শাখায় পাঠায়। পেপারবুক শাখা সেসব যাচাই-বাছাই করে পাঠায় বিজি প্রেসে। ছাপার কাজ শেষ হলে তা আবার ডেথ রেফারেন্স শাখায় পাঠানো হয়। সেখানে চূড়ান্ত যাচাই-বাছাইয়ের পর প্রস্তুত করা হয় পেপারবুক। ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৬ ধারা অনুযায়ী হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স মামলার শুনানি হয়।

এক নজরে সিনহা হত্যা মামলা
২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া শামলাপুর তল্লাশিচৌকিতে নিহত হন সিনহা মো. রাশেদ খান। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় দুটি এবং রামু থানায় একটি মামলা করে। সরকারি কাজে বাধা প্রদান এবং মাদক আইনে এসব মামলা করা হয়। টেকনাফ থানায় দায়ের করা দুই মামলায় নিহত সিনহার সঙ্গী সাইদুল ইসলাম সিফাতকে আসামি করা হয়। আর রামু থানায় মাদক আইনে করা মামলায় আসামি করা হয় সিনহার অপর সঙ্গী শিপ্রা দেবনাথকে। পরে নিহত সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস ২০২০ সালের ৫ আগস্ট বাদী হয়ে কক্সবাজার আদালতে টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে প্রধান করে ৯ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। মামলায় টেকনাফ মডেল থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে করা হয় দুই নম্বর আসামি।

এ মামলাটির পাশাপাশি পুলিশের করা তিনটি মামলার তদন্তভার দেওয়া হয় র‌্যাবকে। ২০২০ সালের ৬ আগস্ট মামলায় অভিযুক্ত ৯ জনের মধ্যে সাত পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পরে আরও সাত আসামিকে বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. খাইরুল ইসলাম ওসি প্রদীপসহ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। অভিযোগপত্রে সাক্ষী করা হয় ৮৩ জনকে। একই দিন পুলিশের দায়ের করা মামলা তিনটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।

২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর আদালত অভিযোগপত্রটি গ্রহণ করে পলাতক আসামি কনস্টেবল সাগর দেবের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। সেই সঙ্গে পুলিশের দায়ের করা তিনটি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে মামলা থেকে সাইদুল ইসলাম সিফাত ও শিপ্রা দেবনাথকে অব্যাহতি দেন আদালত।

এরপর মামলার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কক্সবাজার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম তামান্না ফারাহর আদালত থেকে জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইলের আদালতে স্থানান্তর হয়। ২০২১ সালের ২৭ জুন আদালত ১৫ আসামির বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরুর আদেশ দেন। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে আদালতের বিচার কার্যক্রম স্থগিত থাকায় ধার্য দিনে সাক্ষ্য গ্রহণ সম্ভব হয়নি।

পরে ২০২১ সালের ২৩ আগস্ট থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮ দফায় ৮৩ জনের মধ্যে ৬৫ জন এ মামলায় সাক্ষ্য দেন। গত বছর ৯ থেকে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত মামলার উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পর ৩১ জানুয়ারি কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে বরখাস্ত ওসি প্রদীপ ও এসআই লিয়াকতকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আর ছয় আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দিয়ে বাকিদের খালাস দেন বিচারিক আদালত।

যাবজ্জীবন পাওয়া আসামিরা হলেন- বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের বরখাস্ত উপ-পরিদর্শক (এসআই) নন্দদুলাল রক্ষিত, বরখাস্ত কনস্টেবল সাগর দেব, দেহরক্ষী রুবেল শর্মা, পুলিশের সোর্স শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা নুরুল আমিন, মো. নেজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন। রায়ে খালাস পান- বরখাস্ত কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন ও আব্দুল্লাহ আল মামুন, বরখাস্ত সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) লিটন মিয়া, বরখাস্ত এপিবিএনের উপপরিদর্শক (এসআই) মো. শাহজাহান, বরখাস্ত কনস্টেবল মো. রাজীব ও মো. আবদুল্লাহ।

বিচারিক আদালতের রায়ের সাত দিনের মাথায় গত বছর ৮ ফেব্রুয়ারি মামলার যাবতীয় নথিসহ ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে এসে পৌঁছায়। আর বিচারিক আদালতের রায়ের দুই সপ্তাহের মাথায় খালাসের পাশাপাশি রায় বাতিল ও  খালাস চেয়ে হাইকোর্টে আপিল করেন প্রদীপ-লিয়াকত। পরে যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশ পাওয়া দণ্ডিতরাও আপিল করেন।

ওসি প্রদীপের আইনজীবী অ্যাডভোকেট  রানা দাসগুপ্ত বলেন, এখন পর্যন্ত এ মামলাটি পেপারবুক শাখায় আছে। কোনো অগ্রগতি নেই। ডেথ রেফারেন্স মামলা যে বেঞ্চেই পাঠানো হোক না কেন, প্রশাসনিক ক্ষমতাবলে তা গঠন করে দেন প্রধান বিচারপতি। বর্তমানে হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স মামলার চারটি নিয়মিত বেঞ্চ রয়েছে। ক্রম অনুসারে ২০১৭ সালের ডেথ রেফারেন্সের মামলার বিচার চলছে এসব বেঞ্চে। তবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কিছু চাঞ্চল্যকর মামলার শুনানির জন্য বিশেষ বেঞ্চও গঠন করেন প্রধান বিচারপতি। হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স ও পেপারবুক শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন ২০১৮ সালের ডেথ রেফারেন্স মামলার পেপারবুক তৈরির কাজ চলছে।

জানতে চাইলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বশির আহমেদ বলেন, ক্রম অনুসারে আসলে মেজর সিনহা হত্যা মামলাটি শুনানিতে উঠতে ২০২৬-২৭ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে এই মামলার আাপিল ও ডেথরেফারেন্স  প্রধান বিচারপতি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির নির্দেশনা প্রদান করলে ভিন্নকথা।

মামলার বাদী মেজর সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বলেন, ভুক্তভোগী পরিবার হিসেবে চাইবো মামলাটির বিচার দ্রুত শেষ হোক। যেহেতু অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মামলা শুনানি এবং নিষ্পত্তির নজির আছে। তাই আশা করব এ মামলার ক্ষেত্রেও এমনটা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *