রামগড় স্থলবন্দর নির্মাণে জটিলতা, অস্থায়ী ইমিগ্রেশন সেন্টার প্রস্তুত

Social Share Buttons

খাগড়াছড়ি: বাংলাদেশ ও ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পর্যটন বিকাশে আশার সঞ্চার করছে খাগড়াছড়ির রামগড় স্থলবন্দর ও ইমিগ্রেশন। দেশের ১৫তম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম এ স্থলবন্দর ও ইমিগ্রেশন সেন্টার নিয়ে বৃহত্তর চট্টগ্রামসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছে।

তবে কিছু জটিলতায় এখনও পরিপূর্ণ কাজ শেষ করা যায়নি। বিশেষ করে স্থলবন্দর নির্মাণ কার্যক্রম এখনও শুরু করা যায়নি। অস্থায়ী ইমিগ্রেশন সেন্টার দিয়ে উদ্বোধন করার প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন।

দুই দেশের সরকার স্থলবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়ার পর ফেনী নদীর ওপর যে সেতু নির্মাণের প্রয়োজন ছিল, দুই বছর আগে তা নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে, দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী সেই ‘মৈত্রী সেতু-১’ উদ্বোধনও করেছেন। গত ৮ আগস্ট নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জানান, মৈত্রী সেতু-১ দিয়ে যাত্রী চলাচলের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। আগামী সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের আগে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু-১ দিয়ে যাত্রী চলাচল শুরু হতে পারে।

নৌপ্রতিমন্ত্রী বলেন, আমাদের সব অবকাঠামো হয়ে গেছে। শুধু ইমিগ্রেশনের কারণে আমরা এটি চালু করতে পারছি না। অল্প সময়ের মধ্যে আমরা করে ফেলতে পারবো।

মৈত্রী সেতু দিয়ে স্বপ্নের শুরু:
দীর্ঘ বছরের আলোচনা শেষে বাংলাদেশের রামগড় এবং ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাব্রুম দিয়ে স্থলবন্দর চালুর সিদ্ধান্তে পৌঁছে দুই দেশ। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালে সে দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে বৈঠকে স্থলবন্দর চালুর যৌথ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর ২০১৫ সালের ৬ জুন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু-১ এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং ২০২১ সালের ৯ মার্চ সেতুটির উদ্বোধন করেন। খাগড়াছড়ির রামগড়ে মহামুনি এলাকায় ৪১২ মিটার দৈর্ঘ এবং ১৪.৮০ মিটার প্রস্থ আন্তর্জাতিক সেতুটি নির্মাণে খরচ হয়েছে ১৩৩ কোটি টাকা। এটি দেশের প্রথম মৈত্রী সেতু।

এ মৈত্রী সেতু চালু হলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে এবং উভয় দেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে।

স্থলবন্দর জটিলতা:
রামগড় স্থলবন্দর চালুর লক্ষ্যে রামগড়ের মহামুনি এলাকায় অধিগ্রহণকৃত ১০ একর জায়গায় বন্দরের প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর মধ্যে আইসিপি, কাস্টমস, প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল ভবন, পোর্ট বিল্ডিং, ট্রান্সশিপমেন্ট শেড, ওয়্যার হাউজ, ইয়ার্ডসহ বিভিন্ন অফিস ও আবাসিক ভবন ইত্যাদি নির্মাণের জন্য ১২৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেয় স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য মনিকো লিমিটেড নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী কার্যাদেশ পাওয়ার পর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি কাজ শুরুর প্রস্তুতি নিয়ে সমাপ্ত করার পর গেল বছরে ১১ জানুয়ারি কাজ শুরু করলে বিএসএফ বাধা দেয়। সীমান্তের জিরো রেখা থেকে দেড়শ গজের মধ্যে স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণে আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইনে বিধিনিষেধ এবং স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না থাকায় সে দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ বাধা দিয়ে কাজ বন্ধ করে দেয়। বাধার কারণে কাজটি থমকে আছে। রামগড় সরেজমিন পরিদর্শন করে বিজিবি মহাপরিচালক বিএসএফের আর কোনো বাধা নেই জানালেও এখনও কাজ শুরু হয়নি।

রামগড় স্থলবন্দর প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) মো. সরোয়ার আলম জানান, কাজ করার সম্মতির জন্য বিএসএফের চাহিদা অনুযায়ী প্রকল্পের মাস্টার প্ল্যান, ডিজাইন, ড্রয়িং, লে আউটসহ অন্যান্য তথ্য পাঠানো হয়েছে। তারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পেলে আমাদের জানাবে বলেছে। তারপর আমরা কাজ শুরু করতে পারব।

অস্থায়ী ইমিগ্রেশন সেন্টার প্রস্তুত:
মৈত্রী সেতু নির্ভর রামগড় স্থলবন্দর নির্মাণে সীমান্ত জটিলতায় ১৫০ গজের বাইরে জরুরিভিত্তিতে অস্থায়ী টিনশেড ভবন নির্মাণ করে আপাতত ইমিগ্রেশন কার্যক্রম চালু করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। গেল বছরের ডিসেম্বরে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মেসার্স অনিক ট্রেডিং কর্পোরেশন প্রায় ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ইমিগ্রেশন সেন্টারটি নির্মাণ শেষ করে, যা উদ্বোধনের অপেক্ষায়।

সূত্র মতে, আগ্রহী ভারত আপাতত ইমিগ্রেশনের কার্যক্রম শুরু করতে চাইলেও বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান করে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনে যেতে চায়। মূলত ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এ স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানি কার্যক্রমের আগে ইমিগ্রেশন কার্যক্রম শুরু করার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করায়, প্রথমে ইমিগ্রেশন কার্যক্রম চালু করছে বাংলাদেশ বন্দর কর্তৃপক্ষ।

স্থলবন্দর ও ইমিগ্রেশনে আশার আলো:
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে প্রায় ১১২ কিলোমিটার দূরত্বের এই স্থলবন্দর ব্যবহার করে মাত্র ৩ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ট্রান্সশিপমেন্টের পণ্য যেতে পারবে ভারতে। দেশটির সেভেন সিস্টার্স খ্যাত উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় ত্রিপুরা রাজ্যসহ মেঘালয়, আসাম, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড এবং অরুণাচলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে এই বন্দর দিয়েই। একইসঙ্গে রামগড় স্থলবন্দর ব্যবহার করে চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে পণ্য পরিবহন করতে পারবেন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। ইমিগ্রেশন স্টেশন চালু হলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামসহ আশপাশ এলাকার মানুষ রামগড় ও সাব্রুম সীমান্ত পথে ভারতে ভ্রমণে যেতে পারবেন। একইভাবে ভারতের ত্রিপুরাসহ আশেপাশের রাজ্যের মানুষও এ সীমান্ত পথে বাংলদেশে ভ্রমণে আসবেন। সব মিলে বাড়বে দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পর্যটনসহ বিকশিত হবে পাহাড়ের অর্থনীতি।

বন্দর টু স্থলবন্দর সড়ক যোগাযোগ:
বন্দরকে কেন্দ্র করে সংস্কার হতে যাচ্ছে সড়ক। গত ২৪ মে খাগড়াছড়িতে বারৈয়ারহাট-হেঁয়াকো- রামগড় সড়ক প্রশস্ত করণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন কাজের উদ্বোধন করা হয়েছে। ১১শ ৭ কোটি ১২ লক্ষ টাকা ব্যয়ে রামগড় থেকে বারৈয়ারহাট পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৩৮ ফুট প্রস্থ সড়কের এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। জাইকার তত্ত্বাবধানে কনকর্ড প্রগতি কনসোর্টিয়াম নামক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে বারৈয়ারহাট-হেয়াকো-রামগড় সড়কে ৮টি ব্রিজ ও ৮টি কালভার্ট নির্মাণ সমাপ্ত করেছে। একই প্যাকেজের আওতায় প্রতিষ্ঠানটি রামগড়ের ফেনীরকূল এলাকায় প্রধান সড়কে রোড লোড স্কেল প্রকল্পের কাজ ৯৫ শতাংশ শেষ করেছে বলে জানা গেছে।

এদিকে রামগড় স্থলবন্দর চালু হলে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য আরও প্রসারিত হবে বলে মত দিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম। চট্টগ্রামের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক বিবেচনায় এটি (রামগড় স্থলবন্দর) বেনাপোলের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রাম থেকে বেনাপোল যেতে অনেক সময় প্রয়োজন হয়। কিন্তু রামগড় চালু হলে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে যেসব পণ্য আমদানি রফতানি হয় তা আরও কম সময়ে ও কম খরচে আমদানি করা সম্ভব হবে। যা অর্থনৈতিক বিবেচনায় সারা দেশের জন্য ইতিবাচক। এই স্থলবন্দর ভবিষ্যতে চট্টগ্রামকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে।

আগ্রহী ভারতের সুফল বেশি:
অনুন্নত সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা এবং অতি দূরত্বের কারণে সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যেই সে দেশের সরকার রামগড় সাব্রুম স্থলবন্দর ও ফেনী নদীর ওপর সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। রামগড় থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরের চট্টগ্রাম বন্দরকে কেন্দ্র করেই তাদের এ পরিকল্পনা। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরা লাগোয়া রামগড় বন্দর চালু হলে বাংলাদেশ থেকে সহজে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় রপ্তানি করা যাবে প্রসাধন সামগ্রী, সিরামিক, মেলামাইন পণ্য, সিমেন্ট, ইট, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, তামাক জাতীয় পণ্য, শুঁটকিসহ প্রভৃতি।

রামগড়ের স্থানীয় সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন লাভলু বলেন, রামগড়-সাব্রুম স্থলবন্দর চালুর প্রতিক্ষার প্রহর গুণছে দুদেশের নাগরিকরা। ইতিমধ্যে রামগড় ইমিগ্রেশন ভবনের নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু রামগড় স্থলবন্দরের অবকাঠামোর কাজ এখনও শুরু হয়নি। সীমান্ত সংক্রান্ত সমস্যায় কাজটি বন্ধ রয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।

তিনি বলেন, দুদেশের সরকারের যৌথ সিদ্ধান্তে যেহেতু রামগড় সাব্রুম স্থলবন্দর হচ্ছে, এ অবস্থায় সীমান্ত সমস্যায় এ স্থলবন্দরের উন্নয়ন কাজ বন্ধ থাকা দুঃখজনক। আমাদের দাবি সকল সমস্যা সমাধান করে স্থলবন্দর চালুর প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর উন্নয়ন কাজ দ্রুত সময়ে সম্পন্ন করে বহু প্রতিক্ষিত এ স্থলবন্দরের কার্যক্রম চালু হোক।

শরণার্থী পুনর্বাসন বিষয়ক টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান ও স্থানীয় সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা বলেন, রামগড় স্থলবন্দর যোগাযোগ ও অর্থনৈতিকভাবে আমাদের জন্য আশির্বাদ হবে। আমরা এটি চালুর অপেক্ষায় আছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যুগান্তকারীর সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে এটি একটি। বৃহত্তর চট্টগ্রামসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের বাণিজ্য, যোগাযোগ, পর্যটনসহ সবক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *