শহরের তুলনায় গ্রামে খাদ্যপণ্যের দাম বেশি

Social Share Buttons

দেশে উৎপাদিত মোট খাদ্যশস্যের ৮৫ শতাংশেরও বেশি আসে গ্রাম থেকে। তাই গ্রামে চাল-ডাল-শাক-সবজিসহ সব ধরনের খাদ্যপণ্যের মূল্য কম থাকার কথা। অথচ গত কয়েক মাস ধরে শহরের তুলনায় গ্রামে খাদ্যপণ্যের দাম বেশি। খোদ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ভোক্তা মূল্যসূচকের তথ্য বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে। খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতির এ উল্টো স্রোত বাজার পর্যবেক্ষক ও অর্থনীতিবিদদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।

তারা বলেছেন, জীবনযাপনের ক্ষেত্রে গ্রামের চেয়ে শহরের মানুষ অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন। শহরে খাদ্যের বড় অংশেরই জোগান আসে গ্রাম থেকে। এ কারণে গ্রামের চেয়ে শহরেই খাদ্য উপকরণের দাম বেশি হারে বাড়ার কথা। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতির হারও গ্রামের চেয়ে শহরে বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু তা না হয়ে গ্রামেই মূল্যস্ফীতির হার বেশি বাড়ছে। এটা কেন হলো- তা জরুরি ভিত্তিতে খতিয়ে দেখা দরকার। তা না হলে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিতে পারে।

এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ডক্টর এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘গ্রামের তুলনায় শহরে জীবনযাত্রার ব্যয় বেশি। এ পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু এ ব্যয় বৃদ্ধির হার গ্রামে বেশি, শহরে কম। এটা ঠিক হতে পারে না। আমরা দেখতে পাচ্ছি, গত অর্থবছরজুড়েই এমনটি হয়েছে। এর আগের বছরগুলোতে আবার শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার কম ছিল। হঠাৎ করে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার কেন বেশি বাড়ল এটি খতিয়ে দেখা দরকার।’

তিনি আরও বলেন, ‘রেমিট্যান্সের কারণে গ্রামে এখন বাড়ি-ঘর নির্মাণে অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বেশি বেড়েছে। এটি একটি কারণ হতে পারে। তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি বাড়ার কথা নয়। অথচ এটি হচ্ছে। এখন দেখা দরকার সরবরাহ ব্যবস্থায় কোনো ঘাটতি দেখা দিয়েছে কিনা।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ডক্টর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি গ্রামে বেশি বাড়ার কথা নয়। কেননা, গ্রামে শাকসবজি, মাছসহ বহু পণ্য অনেকের কিনতে হয় না। প্রাকৃতিকভাবেই তারা এগুলো সংগ্রহ করতে পারে। কিন্তু শহরে এগুলো কিনতে হয়। এ হিসেবে গ্রামে বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার কম বাড়ার কথা। এখন দেখা দরকার বিশেষ কোনো কারণে গ্রামে খাদ্য সরবরাহে সমস্যা হচ্ছে কিনা। গ্রামের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমেছে কিনা। আয় ব্যয়ের ভারসাম্য বেশি বেড়েছে কিনা আয় বৈষম্য কতটা বাড়ছে।’

বিবিএস’র দেওয়া তথ্যানুযায়ী, জুন মাসে গ্রামে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ হয়েছে, মে মাসে যা ছিল ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ। অর্থাৎ জুনে গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে দশমিক ৬৩ শতাংশ। অন্যদিকে জুনে শহরে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৯ দশমিক ২৬ শতাংশ হয়েছে, যা মে মাসে ছিল ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ। এ হিসেবে শহরের চেয়ে গ্রামে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতির হার বেশি বেড়েছে দশমিক ৫০ শতাংশ।

অন্যদিকে গত জুনে গ্রামে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৮২ শতাংশে। অথচ এ সময়ে শহরে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৪৫ শতাংশ। অর্থাৎ সার্বিক মূল্যস্ফীতিও শহরের তুলনায় গ্রামে ৩৭ শতাংশ বেশি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মানুষের জীবনযাত্রার সব ধরনের উপকরণের মূল্য ও চাহিদা বিশ্লেষণ করে প্রতি মাসে এগুলোর দাম বাড়া-কমার ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতির হিসাব প্রকাশ করে। এতে খাদ্য, পানীয়, টোব্যাকো, পোশাক-পরিচ্ছদ, জ্বালানি, বিদ্যুৎ, ফার্নিচার, অন্যান্য গৃহসজ্জা, গৃহসামগ্রী, চিকিৎসা ব্যয়, পরিবহণ, বিনোদন, শিক্ষা ও সংস্কৃতি এবং অন্যান্য পণ্য ও সেবার মূল্যসহ জীবনযাত্রার প্রায় সব ধরনের উপকরণ থাকে। এগুলোর সমন্বয়ে একটি সূচক তৈরি করে। এতে খাদ্যপণ্যের ওপর ভর থাকে অর্ধেকের বেশি। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে থাকে কম।

অর্থনীতিবিদরা জানান, শহরের চেয়ে মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি থাকার কারণে গ্রামের মানুষ দু’ভাবে ভুগছেন। প্রথমত, গ্রামেই উৎপাদিত পণ্য কিনতে আগের চেয়ে বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, কৃষক নিজের উৎপাদিত পণ্যের দাম পান না, কিন্তু কয়েক হাত ঘুরে শহরে এসে সেই পণ্যের দাম কয়েক গুণ বেড়ে যায়। এতে শহরের মানুষের ওপরও মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ছে।

এই বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান গ্রামের মূল্যস্ফীতির হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, ‘গ্রামে জিনিসপত্রের দাম তুলনামূলক কম থাকে। চাল-ডাল, শাকসবজি, মাছ-মাংস সবই গ্রামে উৎপাদিত হয়। কিন্তু কয়েক মাস ধরেই গ্রামের মূল্যস্ফীতি শহরের চেয়ে বেশি। গ্রামে মূল্যস্ফীতি কেন বেশি- এর ব্যাখ্যা বিবিএস’র জানানো উচিত।’

এদিকে সরকারের ভুল নীতির কারণে মূল্যস্ফীতির এ উল্টো স্রোত প্রবহমান কিনা তা খতিয়ে দেখতে বাজার পর্যবেক্ষক ও অর্থনীতিবিদরা জোর তাগিদ দিয়েছেন। পাশাপাশি তারা শহরের তুলনায় গ্রামে মূল্যস্ফীতি বেশি হওয়ার বেশ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন।

তারা মনে করেন, উৎপাদিত নিত্যপণ্য মজুত রাখার ব্যবস্থার অভাব গ্রামে উচ্চ মূল্যস্ফীতির অন্যতম প্রধান কারণ। কেননা কৃষিভিত্তিক নিত্যপণ্য গ্রামে উৎপাদন হলেও সেখানে তা মজুত রাখার সুবিধা নেই। ফলে মজুত গড়ে উঠছে শহরে। এছাড়া উৎপাদনের পর পরই সেগুলোর বেশির ভাগই কৃষকের হাত থেকে চলে যাচ্ছে শহুরে মজুতদারদের নিয়ন্ত্রণে। তারা কম দামে কিনে বেশি দামে গ্রামের মানুষের কাছে বিক্রি করছে। এতে পরে নিজের উৎপাদিত পণ্যই বাড়তি দামে কিনছেন কৃষকসহ গ্রামের জনগণ। দ্বিতীয়ত, রেমিট্যান্সের অনুৎপাদনশীল খাতের ব্যয়কে গ্রামের মূল্যস্ফীতির জন্য দায়ী করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, প্রবাসী শ্রমিকদের বেশির ভাগ গ্রামাঞ্চলের। রেমিট্যান্সের অর্ধেকের বেশি যাচ্ছে গ্রামে। বিবিএস’র জরিপ অনুযায়ী, গ্রামে আসা রেমিট্যান্সের ৫৩ শতাংশই ভোগবিলাসে ব্যবহার হচ্ছে। এ থেকে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে।

তৃতীয়ত, গ্রামে সঞ্চয়ের প্রবণতা হ্রাস ও ঋণ গ্রহণ বৃদ্ধিও উচ্চ মূল্যস্ফীতির জন্য দায়ী বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মোট সঞ্চয়ের মধ্যে গ্রামে ছিল ২১ দশমিক ৫১ শতাংশ। এক বছর পর অর্থাৎ ২০২২ সালের ডিসেম্বরে তা ২১ দশমিক ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে। অথচ ওই সময়ে শহরে আমানত বেড়েছে। অন্যদিকে মোট ঋণের মধ্যে গ্রামে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ছিল ১১ দশমিক ২০ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে তা বেড়ে ১১ দশমিক ৭৩ শতাংশ হয়েছে। একই সময়ে শহরে ৮৮ দশমিক ৮০ শতাংশ থেকে কমে ৮৮ দশমিক ২৭ শতাংশ হয়েছে।

গ্রামের মানুষ যথাযথ মজুত করতে না পারার কারণে কীভাবে তারা তাদের উৎপাদিত খাদ্যপণ্য কম মূল্যে বিক্রি করে পরবর্তীতে বেশি দামে কিনছে বাজার পর্যবেক্ষকরা তা সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেছেন। এক গবেষণা রিপোর্ট তুলে ধরে সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৯ সালের জুনে ধানের মজুতে বড় ও মাঝারি কৃষকের অংশ ছিল ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ। বাকি ৮০ শতাংশের মধ্যে ৬০ শতাংশের কিছুটা বেশি মজুত ছিল চালকল মালিকদের কাছে। অবশিষ্ট কমবেশি ২০ শতাংশ মজুত ছিল ধান ব্যবসায়ীদের কাছে। ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও বর্গাচাষিদের ঘরে মৌসুম শেষে বিক্রির জন্য কোনো ধান না থাকায় তাদের এ গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, মিল মালিকরা ধান কাটা মৌসুমে গ্রাম থেকে কম দামে ধান কিনে মজুত করেন এবং মৌসুম শেষে চালে রূপান্তরিত করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে উচ্চ মূল্যে বিক্রি করেন। এ চালের বেশির ভাগ ক্রেতা গ্রামে বসবাসকারী দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ। এভাবে গ্রামের মানুষ তাদের উৎপাদিত পণ্যটি কাটা-মাড়াই মৌসুমে কম দামে বিক্রি করে পরে উচ্চ দামে কিনে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। যারা আর্থিক সামর্থ্যরে অভাবে প্রয়োজনীয় চাল কিনতে পারছেন না, তাদের খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *