কুমিল্লা: দীর্ঘ তিন বছরে ধরে কুমিল্লা জেলা রেজিস্ট্রারি অফিসে নেই কোনো বিবাহ-নিকাহ্ রেজিস্ট্রারের তথ্য। বিয়ে রেজিস্ট্রি করার পর রেজিস্ট্রার বই বছরের পর বছর থাকছে কাজিদের ব্যক্তিগত কার্যালয়ে। অথচ এসব বই সংরক্ষণ ও বার্ষিক বিবাহ-নিকাহ্ তথ্য হিসাব-নিকাশ রাখছেন না কুমিল্লা রেজিস্ট্রারি কার্যালয়। এতে করে বিয়ের রেকর্ড যাচাইয়ে যেমন বাড়ছে জটিলতা, তেমনি এই সুযোগে বিয়ে নিয়ে বাড়ছে প্রতারণা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কুমিল্লা রেজিস্ট্রারি কার্যালয়ের প্রধান সহকারি হালিমা আক্তার বলেন, সর্বশেষ ২০২০ সালে আমরা বিবাহ-নিকাহ্ তথ্য সংগ্রহ করেছি। এরপর পর থেকে আর কোনো তথ্য সংগ্রহ করিনি। যেহেতু নিবন্ধন অধিদপ্তর আমার কাছে কোনো তথ্য চায়নি, তাই আমরা আর এসব তথ্য সংগ্রহ করিনি। তবে এবছর থেকে আপনারা যেহেতু বলছেন, আমরা বার্ষিক তথ্য সংগ্রহ করে রাখবো।
নিবন্ধন অধিদপ্তর তথ্যমতে, কুমিল্লা জেলা ও মহানগর এলাকায় মুসলিম বিয়ে নিবন্ধন কর্মকর্তা (কাজি) রয়েছে ২৮৮ জন। এই ২৮৮ জন কাজির কাছে গত ৫০ বছরের নথি রয়েছে। প্রত্যেক কাজির কাছে গড়ে কমপক্ষে ১৫ হাজার বিয়ে ও তালাক-সংক্রান্ত নথি আছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
সেই হিসেবে ৫০ লক্ষাধিক বিয়ে-সংক্রান্ত নথি রয়েছে তাদের কাছে। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে যা এখন হারানোর পথে। এর বাইরে হিন্দু বিয়ে নিবন্ধন কর্মকর্তা রয়েছে ২১ জন। এর মধ্যে মহানগরে ৫ জন ও প্রত্যেক উপজেলায় একজন করে থাকলেও ব্রাহ্মণপাড়া,দাউদকান্দি উপজেলার ২ জন করে সর্বমোট জেলায় ২১৪ জন রয়েছে ।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কুমিল্লা কাজিদের কাছে ৪০ লাখের বেশি বিয়ের নথিপত্র থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা পাওয়া যাবে না। যদি বিয়ে-সংক্রান্ত তথ্য অনলাইনে রেকর্ড রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয় বা জেলার রেকর্ড রুমে সব নথি জমা দিতে বলে সে ক্ষেত্রে অনেকে দিতেও পারবে না।
তদারকির আওতায় আনলে দেখা যাবে, কারো কাছে রক্ষিত নথি চুরি হয়ে গেছে বা আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়েছে বা বৃষ্টির পানিতে নষ্ট হয়েছে বা ইঁদুরে খেয়ে ফেলেছে। নানা অজুহাত দেখাতে তখন সব কাজি বাধ্য হবেন। এমনকি আরো অনেক ধরনের অনিয়ম সামনে আসতে পারে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিয়ের রেকর্ড সংরক্ষণ করার জন্য কোনো নীতিমালা নেই। ফলে এসব রেকর্ড সংশ্লিষ্ট নিকাহ রেজিস্ট্রারের কাছে সংরক্ষণে রয়েছে। অনেক রেজিস্ট্রারের স্থলে বিভিন্ন কারণে নতুন রেজিস্ট্রার নিয়োগ করা হয়। এক্ষেত্রে দেখা যায়, পুরনো রেজিস্ট্রার তার কাছে থাকা রেকর্ডগুলো নতুন রেজিস্ট্রারকে হস্তান্তর করেন না। ফলে নানা ধরনের জটিলতার সৃষ্টি হয়। এক শ্রেণির প্রতারক চক্র আছে, যারা এসব খোঁজখবর নিয়ে ভুয়া বিয়ে রেজিস্ট্রারের নিকাহনামা সৃষ্টি করেন।
এক্ষেত্রে কেউ কেউ বিয়ের তথ্য জানার জন্য আমাদের কাছে আসেন। কিন্তু আমরা সঠিক কোনো উত্তর দিতে পারি না। এ জন্য জেলার রেকর্ড রুমে সব কাজি/রেজিস্ট্রার প্রতি বছরের রেকর্ডগুলো হস্তান্তর করলে বা জমা রাখলে এই খাতের শৃঙ্খলা আসবে।
তিনি আরো বলেন, কাজিরা একটি বালাম নিয়ে যাবেন জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয় থেকে। ওই বালামের শেষ পাতা পর্যন্ত বিয়ে রেজিস্ট্রি করবেন কাজিরা। পাতা শেষ হলে বালাম জমা দিয়ে নতুন একটি বালাম নিয়ে যাবেন। এভাবে হলেও অনিয়ম দুর্নীতি কমে যাবে। বিয়ে-সংক্রান্ত তথ্য যাচাইয়ের সুযোগ থাকবে জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয় থেকে। এ ধরনের নিয়মের মধ্যে বিবাহ নিবন্ধন কার্যক্রম না আসায় দেখা যাচ্ছে, কোনো একজন নারী জালিয়াত চক্রের সাহায্যে একটি নিকাহনামা তৈরি করে কোনো পুরুষ সদস্যের স্ত্রী দাবি করে আদালতে মামলা করছেন।
সেই মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করানো পর্যন্ত ওই নারীর কাজ। পরে পুরুষটি গ্রেফতার হয়ে আদালতে যাওয়ার পর জানতে পারেন কোনো এক নারী তার স্ত্রী দাবি করে মামলা করেছেন। অথচ কারাগারে যাওয়া ভুক্তভোগী ওই নারীকে চিনেনও না। পরে খোঁজ নিলে দেখা যায় সেটি ভুয়া।
কুমিল্লা মুসলিম নিকাহ রেজিস্ট্রার কল্যাণ সমিতির নেতা কাজী মুফতী বেলাল হোসাইন চিশতী বলেন, আমরা (কাজিরা) প্রতি বছরের হিসাব প্রতি বছর জমা দেই রেজিস্ট্রারি অফিসে, তাদের কাছে হিসাব নেই কোনো,এটা আমাদের ব্যর্থতা না,তাদের ব্যর্থতা। তবে আমি মনে করি বিয়ের নিবন্ধন কার্যক্রম ডিজিটাল হওয়া দরকার। বিবাহ , এতে তথ্য গোপন করে একের পর এক বিয়ে করে প্রতারণা করার সুযোগ থাকবে না।
কুমিল্লা জেলা রেজিস্ট্রার মো: আসাদুল ইসলাম বলেন, আমি নতুন জয়েন করেছি। আসলে আমি বিবাহ-নিকাহ্ নিবন্ধনের সঠিক তথ্য বলতে পারবো না। আমার কাছে বিগত ৩ বছরের কোনো হিসাব-নিকাশ নেই। তবে বিষয়টি নিয়ে আমি কাজিদের সাথে কথা বলে বিবাহ-নিকাহ নিবন্ধনের তথ্য সংগ্রহ করে রাখবো ।
সদ্য বিদায়ী কুমিল্লা জেলা রেজিস্ট্রার মোঃ আনোয়ারুল হক চৌধুরী বলেন, আমি থাকাকালীন সকল বিবাহ-নিকাহ নিবন্ধনের তথ্য রেখে আসছি। নতুন রেজিস্ট্রার কেন এমন কথা বলছেন আমার জানা নাই, সরকারি নিয়ম অনুসারে প্রতি বছর বিবাহ নিবন্ধনের তথ্য জেলা রেজিস্ট্রোর কার্যালয়ে থাকার কথা।
এ বিষয় জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিভাগের রেজিস্ট্রি অফিস সমূহের পরিদর্শক মোঃ আশরাফুজ্জামান বলেন, বিষয়টি আমাদের জানা নেই, কেনো নেই এ বিষয় জেনে আপানাদের জানাবো।