রাজধানীর বনানীর বাসিন্দা ফারজানা আনোয়ার। পেশায় ব্যাংক কর্মকর্তা ছিলেন। সম্প্রতি তার ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। তবে লক্ষণ দেখে তা বোঝার উপায় ছিল না। এরপর চিকিৎসার শুরুতেই গত ৯ জুলাই একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা যান তিনি। শুধু ফারজানা নন, ডেঙ্গুর স্বাভাবিক লক্ষণ বুঝে ওঠার আগেই এমন মৃত্যু হচ্ছে অনেকের। তাদের অনেকেই দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। আবার শক সিনড্রোমে কিছু বুঝে ওঠার আগেই জটিলতা তৈরি হচ্ছে। ফলে মৃত্যুঝুঁকি তৈরি হচ্ছে শিশু, বৃদ্ধ ও জটিল রোগাক্রান্তদের মধ্যে।
ধরন বদলে এখন ভয়ংকর রূপ নিয়েছে ডেঙ্গু। শক সিনড্রোম ডেঙ্গুতে কিছু বুঝে ওঠার আগেই শারীরিক জটিলতা তৈরি হচ্ছে। চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ে যারা হাসপাতালে আসছেন, তারা শুরুতে আসছেন না। ডেঙ্গু হয়েছে কি না বুঝতে না পেরে জ্বরের নানা চিকিৎসা নিতে থাকেন। ফলে অবস্থা জটিল হয়ে যায়, এরপর তারা হাসপাতালে আসেন। হঠাৎ শক সিনড্রোম দেখা দিলে রোগীকে বাঁচানো কঠিন হয়ে যায়। অনেককে আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) নিতে হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের শুরু থেকে রাজধানীসহ সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৮৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। রাজধানীর ৫৩টি সরকারি বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতালে ৬৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সর্বোচ্চ ২২ জন মারা গেছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৫ জন, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে ৬ জন। কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে দুজন এবং বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে এবং ডিএনসিসি কভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে একজন করে মোট ৫ জন মারা গেছেন। বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে ৫ জন মারা গেছেন পুরান ঢাকার আজগর আলী হাসপাতালে। ধানমন্ডির স্কয়ার হাসপাতালে চারজন, বারডেম হাসপাতালে তিনজন এবং ইবনেসিনা হাসপাতালে, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ও পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুজন করে ৬ জন এবং বসুন্ধরার এভারকেয়ার হাসপাতালে আরও একজন মারা গেছেন। এ ছাড়া রাজধানীর বাইরে চট্টগ্রাম বিভাগে ১২ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে তিনজন, রাজশাহী বিভাগে দুজন এবং রংপুর বিভাগে, বরিশাল বিভাগে একজন করে মোট ১৯ জন ডেঙ্গু রোগী মারা গেছেন। আবার মাসের হিসাবে দেখা গেছে, চলতি বছরের প্রথম মৃত্যু হয়েছে জানুয়ারি মাসে। তখন ৬ জনের মৃত্যু হয়। ফেব্রুয়ারিতে তিনজন, এপ্রিলে দুজন, মে মাসে দুজন, জুনে ৩৪ জন এবং জুলাইয়ের গত ১২ দিনে ৪১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সর্বশেষ ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে গতকাল সারা দেশে এক হাজার ২৪৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ঢাকায় ৭০৯ জন এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলায় ৫৩৭ জন চিকিৎসাধীন। অধিদপ্তরের তথ্য ইউনিটের (এমআইএস) ইনচার্জ ডা. মো. জাহিদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে তিন হাজার ৭৯১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন। তাদের মধ্যে ঢাকার ৫৩টি হাসপাতালে দুই হাজার ৫৩০ জন এবং ঢাকার বাইরে অন্যান্য বিভাগে এক হাজার ২৬১ জন। চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত সেখানে ১৬ হাজার ১৪৩ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। শুধু ঢাকা মহানগরে এ পর্যন্ত ১১ হাজার একজন এবং ঢাকার বাইরে পাঁচ হাজার ১৪২ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। গতকাল মৃত্যু হওয়া পাঁচজনকে নিয়ে এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৮৮ জনের। মাস হিসাবে আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্যে দেখা যায়, জানুয়ারিতে আক্রান্ত হয়েছেন ৫৬৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬, মার্চে ১১১, এপ্রিলে ১৪৩, মে মাসে এক হাজার ৩৬, জুনে ৫ হাজার ৯৫৬ ও জুলাইয়ের গত ১২ দিনে ৮ হাজার ১৬৫ জন।
এমন পরিস্থিতিতে রাজধানীর মহাখালী ডিএনসিসি কভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালকে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ (সিডিসি) শাখার উপপরিচালক ডা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ডিএনসিসি কভিড হাসপাতালকে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরই মধ্যে মৌখিকভাবে ঘোষণা হয়েছে। ডেঙ্গু রোগী এই হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। হাসপাতালকে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড ঘোষণা করার জন্য পর্যাপ্ত লোকবল ও সরঞ্জামের ব্যবস্থা এখনো হয়নি। তা হয়ে গেলে খুবই শিগগির পুরোপুরি ডেডিকেটেড হিসেবে হাসপাতালটিকে ঘোষণা করা হবে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন কালবেলাকে বলেন, ডেঙ্গুর চারটি ধরন রয়েছে। প্রতিবছর ডেন-১ রোগী সবচেয়ে বেশি থাকলেও এ বছর ডেন-২ ও ডেন-৩-এর বিস্তার সবচেয়ে বেশি। ডেন-২ প্রায় ৫১ শতাংশ রোগীর মধ্যে পাওয়া গেছে। ডেন-৩ প্রায় ৪৩ শতাংশ। এর মধ্যে কোনটি বেশি ক্ষতিকর, সেটা এখনো বলা যাচ্ছে না। তবে সেকেন্ড টাইম যাদের ডেঙ্গু শনাক্ত হচ্ছে তাদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি দেখা গেছে। আর শক সিনড্রমে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধরা।
এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, আগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে উচ্চ তাপমাত্রা, শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা, চার-পাঁচ দিনের মধ্যে জ্বর কমে যেত, এ সময় প্লাটিলেট কমে যেত এবং রক্তক্ষরণের ঝুঁকি থাকত। তবে এবারের ডেঙ্গুর লক্ষণটাই ভিন্ন। দেখা যাচ্ছে, জ্বরের তাপমাত্রা খুব বাড়ছে না, শরীরের ব্যথাও তেমন হচ্ছে না। সাধারণ জ্বর, সর্দি, কাশি, মাথাব্যথা, গলাব্যথা। অথচ দু-এক দিন পর শরীরের অবস্থার অবনতি ঘটছে। ব্লাড প্রেশার কমে যায়, প্রস্রাব হয় না, কিডনিতে সমস্যা দেখা দেয়। এমনকি রোগী অজ্ঞানও হয়ে যাচ্ছে। এটাকে বলে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। এটা সবচেয়ে ভয়াবহ।
তিনি বলেন, এবার ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ এই শক সিনড্রোম। এর আরেকটি কারণ হলো, এসব রোগীর মধ্যে বেশিরভাগই এর আগেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। হয়তো তারা আগে সামান্য জ্বর, কাশি ভেবে বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। ফলে যারা দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থবার আক্রান্ত হচ্ছে তারা এই ডেঙ্গু শক সিনড্রোম দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেন। অবহেলা করলে ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে ভোগার আশঙ্কা রয়েছে। তখন অনেক সময়ই চিকিৎসকদের কিছু করার থাকে না। তখন আইসিইউতে ভর্তি হতে হয়।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মোঃ মিজান উদ্দিন
Copyright © 2024 Topheadline. All rights reserved.